ব্যথার রাজ্যে আনন্দের খোঁজে

পৃষ্ঠা – ১৯৭
মুদ্রিত মূল্য – ৪০০.০০ টাকা
২৫% ছাড়ের পর মূল্য - ৩০০.০০ টাকা
প্রকাশনী – বিবলিওফাইল প্রকাশনী
অন্ধকারে ঢাকা এক শহর। এক অজানা যাত্রার শুরু। মস্তিষ্কের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক দুষ্ট স্নায়ুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসেছেন তিনি। কিন্তু এই যাত্রা কেবল একটি অপারেশনের গল্প নয়—এটি এক গভীর রহস্যের উন্মোচন।
কেন তিনি এই পথে পা বাড়ালেন? কী এমন ঘটেছিল, যা তাঁকে বাধ্য করল নিজের জীবন এবং ভবিষ্যৎকে বাজি রাখতে? হাসপাতালের শীতল করিডোর থেকে দিল্লির ব্যস্ত রাস্তাগুলো পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক নতুন চ্যালেঞ্জের জন্ম দেয়।
"ব্যথার রাজ্যে আনন্দের খোঁজে" এমন একটি কাহিনি, যেখানে প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে আছে নতুন আবিষ্কার, নতুন প্রশ্ন। বন্ধুত্বের শক্তি, পরিবারের অটুট বন্ধন, আর জীবনের প্রতি অদম্য আকর্ষণ—সবকিছু মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছে এক অনন্য দলিল।
কিন্তু এই গল্প কি শুধুই আনন্দ আর মানবিকতার? নাকি এর গভীরে লুকিয়ে আছে এমন কিছু, যা পাঠককে বাধ্য করবে বারবার ভাবতে? প্রতিটি পৃষ্ঠা আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে এক অজানা জগতে, যেখানে ব্যথা আর আনন্দ হাত ধরাধরি করে চলে।
আপনি কি প্রস্তুত এই রহস্যময় যাত্রায় অংশ নিতে? "ব্যথার রাজ্যে আনন্দের খোঁজে" শুধু একটি ভ্রমণ কাহিনি নয়; এটি একটি থ্রিলার, যা পাঠকের হৃদয়ে দোলা দেবে এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেবে।
রিভিউঃ Rehnuma Prapty
❛অসুস্থ হলেই একমাত্র বোঝা যায় সুস্থতা কত বড়ো নেয়ামত!❜
আমাদের এই দেহঘড়ি ২৪ ঘন্টা বিরতিহীনভাবে চলছে। প্রতিটি অঙ্গ ঠিকমতো কাজ করছে বলেই আমরা চলতে ফিরতে পারছি। পারছি নিজের মতো থাকতে। তবে দেহঘড়ি চলতে চলতে ক্লান্ত হয়, কখনো বিকল হয় আর সেই ঘড়ির মেয়াদ ফুরোলে বিলীন হয়ে যায়। দেহঘড়িতে একটু সমস্যা দেখা দিলে একটু চিকিৎসা করে আবার সচল করা যায়। তবে সেই প্রক্রিয়াটা কখনো সরল, কখনো জটিল। রোগের পরিমাণের উপর নির্ভর করে চিকিৎসা।
মানব দেহ এক অপার রহস্যের আধার। সৃষ্টিকর্তার নিখুঁত সৃষ্টির এক জ্বলন্ত উদাহরণ। তবে এই দেহ চলতে চলতে ক্ষয়ে যায়, বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়, অসুস্থ হয়। তেমনই এক অসুখ ❛ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া❜। মুখের পেশীর বেশ অদ্ভুত কিন্তু ভোগান্তির এক রোগ এটি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায়,
❛এটি এমন এক রোগ যেখানে আপনি কাঁদতে চাইলে হাসবেন, আবার যদি চান হাসতে তখন দেখবেন কাঁদছেন!❜
আর সেই সাথে তীক্ষ্ণ ব্যথা তো আছেই। দেহের স্বাভাবিক চলন প্রক্রিয়ার মধ্যে বিদ্রোহ করে বসা এই রোগ আপনাকে ভোগাবে। যেমন ভুগিয়েছে লেখককে।
পেশায় চিকিৎসক হওয়ায় পেশীর এই বিদ্রোহকে তিনি সহজেই ধরে ফেলতে পেরেছেন। কেমন ব্যাপার না, আজীবন রোগীর চিকিৎসা করে যাওয়ার পর নিজেই যখন রোগীর চরিত্রে আসন পান তখন কেমন হয়?
এই রোগের সাথেই শুরু হয় ব্যথার রাজ্যে প্রবেশ। তবে রোগকে বাড়তে দেয়া মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। তাই ওষুধে যখন ধরছিল না তখন সিদ্ধান্ত হলো নিজেকে ছু রি, কাচির নিচেই সমর্পণ করা তথা অ স্ত্রোপচার করা।
এখানেই যাত্রা হলো স্বাস্থ্য পর্যটনের। ভিনদেশে জটিল অ স্ত্রোপচারের জন্য পাড়ি জমানোর পাশাপাশি ভিনদেশটা একটু ঘুরেও দেখা। বায়ু পরিবর্তন বলা যায়।
ভিনদেশ হিসেবে বেছে নেয়া হলো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতকে। সেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ধারনা সকলেরই আছে। তবে এই কয়েক মাসে আগের দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে পাশের দেশের সাথে সম্পর্কের অবনতি মিলিয়ে সেখানে চিকিৎসার জন্য যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে গেল। নানা কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি পেলেন নিজেকে সুস্থ করতে যাওয়ার সম্মতিপত্র তথা ভিসা। আর চিকিৎসা মানেই টাকার খেলা। উন্নত চিকিৎসার জন্য পয়সা খসাতে হবে। এই বিপদেও তিনি পেলেন কাছের মানুষের সহযোগিতা সাথে সাস্থ্য বীমার ভরসা।
শুরু হলো দিল্লি যাত্রা। সঙ্গী লেখকের কাছের ছোটো ভাই। মস্তিষ্কের জটিল অ স্ত্রোপচার কোনো ছেলেখেলা নয়। আছে ঝুঁকি, আছে অনিশ্চয়তা। তবে নিজেকে হার না মানিয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে তিনি প্রস্তুত। জীবন প্রতি পদে শিক্ষা দেয়, প্রতি মোড়ে বাঁক পরিবর্তন করে।
কখনো জিওপির জন্য অপেক্ষা, কখনো সামনে কী হবে সে অনিশ্চয়তা আর সঙ্গী হিসেবে ব্যথা তো ছিলই। তবে মানুষ জীবনের সকল প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে সবসময় দৃঢ় থাকে।
দুঃখের মাঝেও আনন্দকে খুঁজে নিতেই তিনি বেরিয়ে পড়লেন দিল্লি দর্শনে। কুতুব মিনার, লাল কেল্লা, দিল্লির অলিগলি, মল, দিল্লির মুখরোচক খাবার চেখে দেখা, চাঁদনী চক ইত্যাদি জায়গা।
দিল্লির প্রতিটি গলি, দর্শনীয় স্থান যেন একেকটা ইতিহাসের সাক্ষী। কুতুব মিনার যেমন কালের সাক্ষী হয়ে নিজের ইতিহাসের জানান দিচ্ছে তেমনি লাল কেল্লার প্রতিটি কোনা জানাচ্ছে মুঘল আমলের শান শকাতের কথা। দাওয়াহ-ই-আম থেকে সম্রাটের আমোদ কক্ষ, দরবার, সংগ্রহশালা কী করে কালের বিবর্তনে ইংরেজ বাহিনীর সৈন্য ঘাটি হয়ে তার সৌন্দর্য হারালো সেই করুণ ইতিহাসও উঠে এসেছে। উঠে এসেছে আলু পরোঠা কিংবা কেরালার মুখরোচক খাবারের স্বাদ। বিরিয়ানি, স্ট্রিট ফুড, মোমো থেকে শুরু করে ভিন্ন স্বাদের চা সবই ব্যথাকে সঙ্গী করে চেখে দেখেছেন লেখক।
একইসাথে চলেছে নিজেকে সুস্থ করার কার্যক্রম। দিন ঘনিয়ে আসলে নিজেকে সপে দিতে হয়েছে ডা. বিপিনের অপারেশন টেবিলের নিচে। অ্যানেসথেসিয়ার প্রভাবে যখন চেতনা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল তখন কি ভয় হয়নি? হতে পারে এটাই জীবনের শেষ জাগ্রত মুহূর্ত?
দীর্ঘ ঘন্টা পর যখন চোখ একটু আলোর দেখা পেলো তখন মাথায় তীব্র বেদনার অনুভূতি, ঘুম কিংবা জাগরণের মাঝে দোলাচল, আবছা দৃষ্টিতে সামনে ঝাপসা কাউকে দেখা আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে নিজেকে ধাতস্থ করতে গিয়ে কি মনে হয়নি, একটা যু দ্ধ প্রায় অর্ধেকের বেশি জয় করা হয়ে গিয়েছে? এইটুক যখন আসা গেছে বাকিতেও উতরে যাওয়া যায়।
একটা হাসপাতাল যেন শুধু চিকিৎসা নেয়ার জায়গা নয়। এখানে নানা রোগের, নানা রোগীর আগমন ঘটে। যাদের প্রত্যেকের আছে একটা করে অজানা গল্প। এই যেমন পাশের বেডের আয়েশার মায়ের গল্পটা লেখক নিজের মতো কল্পনা করেছেন। আবার জেনেছেন ইয়েমেনি পুত্রের মাকে সুস্থ করতে আসার দীর্ঘ যাত্রা এবং ত্যাগের গল্প। সেই কষ্টগুলোর মাঝে রোগী হিসেবে নিজেকে কখনো হয়তো একটু ভাগ্যবান মনে হয়েছিল।
হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে যখন ক্রমশ সুস্থতার পথে তখনই আবার দিল্লির পথে ঘাটে ঘুরে বেড়িয়েছেন, চেখে দেখেছেন দিল্লির রসনা বিলাশ।
এরপর দিনটা ছিল ডিসেম্বরের এক তারিখ, ২০২৪। দিল্লির আকাশ তখন রাতের আধারে ঘনিয়ে গেছে। আধো ঘুম অবস্থায় যখন দুই রুমের বেজমেন্টের দরজায় টোকার শব্দ হলো তখন তিনি অবাক হয়েছেন অবশ্যই! অচেনা এই দেশে কে আসবে তার কাছে? সঙ্গী ছোটো ভাই এহসান তো বাইরে বেরিয়েছে, যার সঙ্গে ঘরে ঢোকার চাবি আছে।
দরজা খুলে দেখা গেল সুদূর কানাডা থেকে হাজির লেখকের বোন। পরদিন যে ভাইয়ের জন্মদিন! একে অসুস্থ এরপর আবার ভাইয়ের জন্মদিন। কী করে দূরে থাকা যায়? তাই চমকে দিতেই এসে পড়া। মানুষ চেনা যায় বিপদে, অসুস্থতায়। লেখকের পাশে ঠিক এই সময়েই ছিল এমন কিছু মানুষ যাদের সহযোগিতা আর ভালবাসা তাকে কঠিন এই পথে চলতে অদম্য সাহস যুগিয়েছে। ভরসার হাত দুটোর বদলে কয়েক জোড়া ছিল বলেই হয়তো কঠিন সময়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লড়ে যেতে পেরেছেন।
অ স্ত্রোপচার পরবর্তী হালকা জটিলতা দেখা দিলেও ভাগ্যবিধাতা আগের মতো আর বাঁকা হাসি হাসেননি। দীর্ঘ দুই সপ্তাহের বেশির যাত্রার পর তাকে আবার ফিরিয়ে এনেছেন স্বদেশের মাটিতে।
দিল্লিতে চিকিৎসা নেয়া শুধু একটা সুস্থতার যাত্রা নয়, ছিল দ্বিতীয় জন্ম। নিজেকে নতুন করে জানা গেছে। কঠিন সময়ে নিজেকে ধরে রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ঠিকই ব্যথার মাঝে আনন্দের খোঁজ করে নিয়েছেন।
কাঁটা পেয়েও ফুল দান করার মতো করেই রোগকে জয় করেছেন। অভিজ্ঞতার ভান্ডারে নতুন গল্প যোগ হয়েছে। যোগ হয়েছে নিতান্ত ক্ষুদ্র জিনিসের মাঝেও লুকিয়ে থাকা শিক্ষা।
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
❝ব্যথার রাজ্যে আনন্দের খোঁজে❞ এস এম নিয়াজ মাওলার লেখা ভ্রমণকাহিনি। আরো ঠিকভাবে বললে বলা হবে স্বাস্থ্য পর্যটন বিষয়ক লেখা।
লেখককে আমরা চিনি পুরাণের লেখক হিসেবে। নানা দেশের পুরাণ নিয়ে ঢাউস সাইজের বই লিখে তিনি পাঠকের কাছে পরিচিত। আরো একটু বেশি পরিচিত ঢাউস সাইজের বইগুলোর সাধ্যের বাইরে মূল্যের কারণেও। তবে এবার তিনি আবির্ভূত হয়েছেন নিজের প্রচলিত লেখার গন্ডির বাইরে। নিয়ে এসেছেন ব্যক্তিগত জীবনে হওয়া নতুন এক অভিজ্ঞতাকে। যাকে ভ্রমণকাহিনি হিসেবে পৌঁছে দিয়েছেন পাঠকের কাছে।
গত বছর শেষের দিকে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন কঠিন এক ব্যাধিতে। যা তাকে শেষ পর্যন্ত ভিনদেশে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করে। সেই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই লেখক বইটি রচনা করেছেন।
কয়েকটি অধ্যায়ে সুন্দর কিছু শিরোনামে সজ্জিত বইটির শুরু হয়েছে ব্যথার রাজ্যে প্রবেশের মধ্য দিয়ে। যেখানে সুস্থ হওয়ার তাগিদে লেখককে সম্মুখীন হতে হয়েছিল নানা বাধার, ভাগ্যের জটিল খেলা আর একেকবার হাসি আর হতাশার অদ্ভুত দোলাচলে দুলেছেন তিনি।
তবে আমি বলবো তিনি অনেক দিকেই ভাগ্যবান। আশপাশে পেয়েছেন অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী, পাশে থাকার মানুষ এবং ব্যথার মাঝেও একটু মুখে হাসি ফোটানোর স্বজন।
অসুস্থতা থেকে সুস্থতার যাত্রায় প্রতি পদে তিনি যে শিক্ষা পেয়েছেন সেগুলো দারুণ সুন্দর উপমায় প্রকাশ করেছেন। সেই সাথে দিল্লির রাস্তায় বিচরণের কথা, দিল্লির ইতিহাস, রসনা এবং অদেখা ব্যাপারগুলোও তুলে ধরেছেন।
ভ্রমণের সাথে সাথে ইতিহাসপাঠ হয়ে গেছে বেশ। জানতে পেয়েছি পশমিনা শালের ইতিহাস, বিপত্তি আর সম্ভাবনার কথা, মুঘল আমলের বিলাসিতা, তাদের প্রযুক্তি আর কালের বিবর্তনের কথা।
বর্ণনার ভঙ্গি ভালো ছিল বলে এটা যে নন ফিকশন সেরকম মনেই হয়নি। সেইসাথে লেখককে বাস্তব অভিজ্ঞতাকে আরো পূর্ণতা দান করতে অজানা সেই রোগী যার কন্যার নাম আয়েশা তার গল্পের দুটো সমাপ্তি লিখেছেন লেখক নিজের মতো করে। এই অংশটা দারুণ ছিল।
লেখকের লেখা বেশ দ্রুত গতির। কঠিন রোগকে বেশ সাবলীলভাবেই ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তবে সেখানে বারবারই একই জাতীয় শব্দ আর উপমার প্রয়োগ কিছুটা একঘেঁয়ে লাগছিল। আবার কিছু উদাহরণ আমার কাছে মনে হয়েছে মানানসই না (আইফোন কেনার উদাহরণ বা উপমাটা মিল লাগে নি আমার কাছে)। তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় হয়তো সেটাকেই লেখকের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে।
১৯৮ পাতার এই অভিজ্ঞতার বর্ণনায় এটা বেশ বুঝা গেছে অসুস্থতাকে জয় করতে নিজের আত্মবিশ্বাস, আশপাশের শিক্ষা আর কিছু ভরসার মানুষ কত জরুরি। সেই সাথে জরুরি আর্থিক অবস্থা ঠিক থাকার। আর এখানেই গুরুত্ব পেয়েছে আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য বীমার কথা। যে সুবিধা চাকরিসূত্রে লেখক পেয়েছেন সেটা একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বা রোগী হিসেবে দেশের প্রতিটি মানুষের থাকা উচিত। এই নিশ্চয়তা আমাদের দেশের চিকিৎসা খাত এবং ব্যবস্থাকে অনেক পরিবর্তন করে দিতে পারে।
লেখক নিজের অসুস্থতার বর্ণনাকেই এখানে প্রাধান্য দিয়েছেন এমনটা নয়। আমার মনে হয়েছে বেশিরভাগ জুড়ে ছিল ভারতের দিল্লির বর্ণনা। তাদের ঐতিহ্য, আধুনিকতা, চিকিৎসা ব্যবস্থা, খাবার, দর্শনীয় স্থানের বর্ণনা সাথে জুড়ে থাকা অজানা ইতিহাস। লেখকের বর্ণনাতেই দিল্লি দর্শন হয়ে গেছে।
লেখক যেমন ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রশংসা করেছেন। তেমনি ভুলে যাননি আপন ভূমিকেও। আমাদের দেশ আসলে কতটা সম্ভাবনার সেটাও উল্লেখ করেছেন। শুধুমাত্র দরকারি পদক্ষেপ আর কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা পারে চিকিৎসা খাতে আমাদের দেশকেও উন্নত করার। শেষে লেখক এই খাতে আমাদের উন্নয়ন করার আশা ব্যক্ত করেছেন।
এই বইটা পড়ার সময় কখনো না কখনো অসুস্থতার সম্মুখীন হয়েছেন, ছু রি কাচির নিচে নিজেকে ফেলতে হয়েছে এমন মানুষ বেশ ভালো রিলেট করতে পারবেন। অসুস্থতা আর চিকিৎসার সময়টুকু একজন রোগীর কাছে কেমন কাটে অনুধাবন করা যায়।
আমার এই জীবনে অস্ত্রোপচারের টেবিলে যেতে হয়েছে দুইবার। প্রথমবার আমি বেশ এক্সাইটেড (!) ছিলাম বলতে দ্বিধা নেই। সিনেমায় OT লেখা দেখতাম। লাইট জ্বলছে নিভছে। টেবিলের গোল লাইটের নিচে রোগীর জীবন ম রণের সিদ্ধান্ত হচ্ছে। ব্যাপারগুলো আমার কাছে কিছুটা ফ্যান্টাসির মতো ছিল। তো প্রথমবার আমাকে যখন সার্জারির আগে অবজার্ভেশন কক্ষে রাখা হলো আমি বেশ হালকাই ছিলাম। হাতে ক্যানুলা নিয়েও রুমের এই সেই ঘেঁটে দেখছিলাম। বাকিরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার দিক। এরপর যখন আমাকে অ্যানেসথেসিয়া দেয়া হলো ঐ অনুভূতি ব্যক্ত করা সম্ভব না। অতল ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে আমি শুধু চাইছিলাম এই মুহুর্ত যেন নেক বান্দার পুলসিরাত পার হওয়ার মতো গতিতে চলে যাক। এরপর আর কিছু মনে নেই..
যখন চোখ খুলেছিলাম তখনো আমি জানিনা আমার সার্জারি শেষ। উঠতে গিয়ে তীব্র ব্যথায় আচ্ছন্ন হলাম। লেখকের জ্ঞান ফেরার বর্ণনাও আমার অভিজ্ঞতার কাছাকাছি ছিল। তবে লেখকের অস্ত্রোপচার আমার থেকে কয়েক গুণ জটিল ছিল।
তবে দ্বিতীয়বার সার্জারিতে আমি যারপরনাই ভীত ছিলাম। রোগটা আমাকে এক দশকের বেশি সময় ভুগিয়েছে। ঐ অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। যা আমাকে এখনো পীড়া দেয়।
ডাক্তার, হাসপাতাল, রোগ আর রোগী এই ব্যাপারটা গত দুই বছর ধরে আমার কাছে একটা মানসিক ধাক্কার মতো। অনেক আগে থেকেই আমি রোগী দেখতে যেতে পছন্দ করিনা। আমার দমবন্ধ লাগে। দুই বছর আগের পারিবারিক একটা অভিজ্ঞতা আমাকে আরো বেশি ধাক্কা দিয়েছে। যার ফলস্বরূপ আমি নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতালের সামনে দিয়ে গেলে চোখ বন্ধ করে যাই। যেন স্মৃতিগুলো আমার চোখে না ভাসে। এমনকি আজও কোনো হাসপতালের সামনে দিয়ে গেলে আমি চোখ কান বন্ধ রাখি। মানসিক, আর্থিক আর শারীরিক ক্ষতি সেটা একজন রোগীর হয় সাথে তার সঙ্গে থাকা ব্যক্তিরাও কিছুক্ষেত্রে সেই ট্রমা ভুলতে পারে না। এই বইটা পড়তে গিয়ে আমি নির্দিষ্ট কয়েকটা বছরের ঘটনা যেন আবার চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম।
আর একজন চিকিৎসক যখন নিজেই রোগীর আসনে অধীন হোন তার অনুভূতিও বোঝা যায়।
এই বইয়ের ভালো মন্দ দিক থেকে আমার কাছে মূল মনে হয়েছে কঠিন সেই অভিজ্ঞতাটা। লেখক যথেষ্ঠ আবেদন, আবেগ দিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছেন। রোগের ব্যাখ্যায়, রোগে ভোগা অংশগুলো যেমন পীড়া দিচ্ছিলো, তেমনি দিল্লির ইতিহাস, অলিগলি বর্ণনা মুগ্ধ করেছিল। আবার জিভে জল এনেছিল রসনার বর্ণনা। আনন্দ দিয়েছিল পরিবার আর বন্ধুদের চমকে দেয়া, পাশে থাকার বর্ণনা।
লেখকের লেখা এই নিয়ে তিনটা বই পড়া হয়েছে। আমি নিঃসন্দেহে এই বইকেই এগিয়ে রাখবো। আমার মতে বইটি শুধু একটা ভ্রমণকাহিনি না অসুস্থতাকে জয় করার আখ্যান। লেখকের সাথে আগে কাজ করায় তাকে চিনি। তিনি কতটা উচ্ছল এবং প্রাণবন্ত জানি। তিনি দীর্ঘ কয়েকটা মাস যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন সেটা অল্প হলেও জানতাম। তবে এখানে বিস্তারিত জেনে অবাক হয়েছি। এত কিছুর মাঝেও তিনি নিজের কাজ করে গেছেন।
লেখকের সুস্থতা কামনা করি। আর আশা করি ভবিষ্যতে আমার দেশের চিকিৎসা পদ্ধতি যেন এত উন্নত হয় যেন ভিনদেশের কোনো রোগী আমার দেশের ব্যবস্থা, ইতিহাস, অলিগলি, সৌন্দর্য আর খাবার নিয়েও আপন অভিজ্ঞতা লিখুক।
ভ্রমণকাহিনি আমার খুব একটা পড়া হয়নি। তাই এই ঘরনায় রিভিউ লেখা আমার জন্য কঠিন। কঠিন কাজটা করতে পেরেছি নাকি জানিনা। এই বইটা যখন পড়ছি তখন আমি নিজেও শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। অসুস্থ থাকলে মন নরম থাকে শুনেছি। তাই হয়তো বইটা রিলেট করতে পেরেছি একটু বেশি।
প্রচ্ছদ, প্রোডাকশন:
বইয়ের প্রচ্ছদটা মনোরম। বইয়ের প্রোডাকশন বেশ ভালো। বানান ভুল বা প্রমাদ তেমন চোখে পড়েনি।
❛ব্যথার রাজ্যে আনন্দের খোঁজে,
অশ্রুর ফোঁটায় রংধনু রোজে,
আলো খোঁজে মন আঁধারের সীমানোজে।❜
বই: ব্যথার রাজ্যে আনন্দের খোঁজে
লেখক: এস এম নিয়াজ মাওলা
প্রকাশনী: বিবলিওফাইল