মোহরানার সেই সন্ধ্যার আলো ঝলমলে কথাটি এখনো কানে বাজে—
“ডিভোর্স হবে না কি কোনোদিন?”
সেই এক সরল, ফাঁদপাতা নির্ভার বাক্য। অথচ কী প্রচণ্ড ওজন নিয়ে তা বসেছিল আমার জীবনের অন্যমনস্ক অক্ষরগুলোয়। তখন বুঝিনি, একদিন এই কথার দংশনেই আটকে যাব বছর বছরের দীর্ঘশ্বাসে। একটুখানি আশার বুনটে, একটুখানি সম্ভাবনার ধূসর রশিতে, আমি জড়িয়ে ছিলাম নিজেকে। ভেবেছিলাম, শেষমেশ সে ফিরবে, বলবে—“চলো, সব আবার শুরু করি।”
আমি ভাবতাম, আমার দুই পুটুলিকে বুকের ভেতর তুলে নেব, তাদের ঘামের গন্ধে আর নিঃশ্বাসে পূর্ণ করব ঘর। কিন্তু তারা ছিল না, আমি ছিলাম না, ছিল না আমাদের বলা না-বলা কথার মাঝের সেই গোপন মেলবন্ধন।
ছিল কেবল দুটি পথ—যেখানে আমরা হাঁটছিলাম বিপরীত দিকে, শব্দহীন পায়ে, প্রতিজ্ঞাহীন বিদায়ে।
আমার পরবর্তী বই। আমার মিশর।
অনেকদিন ধরে বিবলিওফাইল–কে বলে আসছিলাম, এবার থ্রিলার দেব। সেই লেখা চলছে ঠিকই। কিন্তু হঠাৎ মিশর এক ধাক্কায় সব পাল্টে দিল।
আমি মিশরে ঘুরতে যাইনি। গিয়েছিলাম দেখতে—চেনা ইতিহাসকে নতুন চোখে, জানা পুরাণকে নতুন নিঃশ্বাসে। বুঝতে পেরেছি, মিশরের প্রতিটি বালিকণায়, প্রতিটি প্রাচীরে, প্রতিটি নিঃসীম নিরবতায় পুরাণ নিজস্ব নিয়মে শ্বাস নেয়।
এই ছবিটায় যে তরুণী হেসে আছে, আলো ছুঁয়েছে যার কপোল, নাম তার নাবিলা। আমার সবচেয়ে ছোট বোন। জন্মের ব্যবধান এক যুগের; আমি আর নিশাত তার থেকে এতটাই দূরে, যেন ভিন্ন এক প্রজন্মের সূচনা সে। আব্বু চলে যাবার পর, পৃথিবীর রূক্ষতাকে বুকে নিয়ে বেড়ে ওঠা সেই মেয়েটির ভবিষ্যৎ নিয়ে রাতের পর রাত বুকের ভেতর কাঁটা হয়ে বিঁধত। কীভাবে এত বড় হবে? কীভাবে পাড়ি দেবে জীবনের কঠিন পথগুলো? কীভাবে খুঁজে নেবে তার নিজস্ব ছন্দ? অজানা এক আতঙ্কে ছেয়ে থাকত মনের আকাশ।
হ্যালো, আমি সাইয়েদার বড় ভাই। একটু আগে নাবিলাকে নিয়ে লিখেছিলাম, আর এখন লিখছি সাইয়েদাকে নিয়ে! আরেহ! সাইয়েদাই হচ্ছে নিশাত, কিংবা নিশাতই হচ্ছে সাইয়েদা!
সাইয়েদা এখন একজন থেরাপি ইন্টার্ন। সে দক্ষিণ এশিয়ান কানাডিয়ানদের জন্য ভার্চুয়াল কাউন্সেলিং করে। আমি নিজে দেখেছি কীভাবে আমাদের সংস্কৃতি, পারিবারিক চাপ, বা আর্থিক টানাপোড়েন মন ভেঙে দিতে পারে। সাইয়েদা সেসব গভীর থেকে বোঝে– কারণ সে শুধু পড়েইনি, আমাদের পরিবারের সংগ্রামও তার চোখের সামনেই হয়েছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার তুলে দেওয়া দরকার—এই কথাটা আমি আবেগে বলছি না। মাঝরাতে মধ্যপ্রাচ্যে যা ঘটে চলেছে, সেটাই একমাত্র কারণ নয়। এসব ঘটনা আমরা অনেক আগেই দেখেছি, বরং আমি তো জন্ম থেকেই দেখে আসছি।
আমি যে কতদিন ঈদ করি না—ঠিক করে মনে পড়ে না। হৃদয়ের ভেতর কোথা থেকে যেন উৎসাহের সে দীপ্ত শিখাটাও নিভে গিয়েছিল বহু আগেই। ঘড়ির কাঁটায় ঈদের দিন আসে, যায়; কিন্তু তাতে আর আমার ভেতরের আকাশে নতুন চাঁদ ওঠে না। মনে হয়, ধীরে ধীরে চারপাশের মানুষগুলোও সেই চাঁদের আলো থেকে সরে যাচ্ছে, ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে। যাদের একদিন ভাবতাম হৃদয়ের খুব কাছের, তাদের সঙ্গে এখন শব্দের দূরত্ব, স্পর্শের শূন্যতা। আর যাদের সঙ্গে নতুন করে বন্ধনের আশ্বাস খুঁজতে চাই, তারাও যেন কোনও অদৃশ্য বেড়ার ওপারে থাকে, ঠিক নাগালের বাইরে।
Subcategories
এস এম নিয়াজ মাওলা সম্পর্কে
এস এম নিয়াজ মাওলা। পেশায় একজন চিকিৎসক আর নেশায় একজন নবীন কথা সাহিত্যিক। পেশাগত জীবনটাকে মানুষ সিরিয়াসলি নেয়। এই পেশাগত জীবনের টানেই ছোটবেলা থেকে এত পড়াশুনা করে, এত এত ডিগ্রী নিয়ে একটা পর্যায়ে এসে মানুষ থিতু হয়। ক্যারিয়ার চলতে থাকে আপন গতিতে। সময়টাও চলতে থাকে নিজের মতো করে। ব্যাপারটায় কেমন একটা বাধ্যবাধকতার গন্ধ পাওয়া যায়। তাই না? পেশাগত জীবনটাকে চাবি দিয়ে ঠিকঠাক না রাখলে পুরো জীবনটাই তছনছ হবার পথে চলে যায়। অথচ এই জীবনটাকে ঠিক রাখতে মনের খোরাকের ব্যবস্থাও করতে হয়! নিয়াজ ভাইয়ের এই মনের খোরাক হচ্ছে লেখালেখি!