ব্যথা যখন গাঢ় নীল রাত্রির মতো চেপে বসে, মানুষ শিকড়হীন গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকে—মাটি নেই, পাতা ঝরে, কিন্তু পতনের শব্দটুকুও পৃথিবী শুনতে পায় না। তার হৃদয়ে তখন অদৃশ্য ভূমিকম্প; চোখের সামনে ভাঙাচুরা হয়ে যায় সমস্ত আলোর শহর, অথচ ঠোঁট দুটো জমে যায় বরফের ভাষায়। সে হাত বাড়ায় সাহায্যের দিকে, কিন্তু হাতের আঙুলেই লেখা থাকে অদৃশ্য এক কবিতা: "আমি একা।"
এই একাকিত্ব কখনো শূন্যতা নয়, এটি এক ধরনের গর্ভ। যেখানে ব্যথার বীজ অঙ্কুরিত হয়, শিকড় ছড়ায় মাটির গভীরে, আর নির্বাক অন্ধকারেই জন্ম নেয় অজানা ফুল। অন্তর্মুখী মানুষেরা যেন নক্ষত্রের গুহাবাসী—তারা আলো ছড়ায়, কিন্তু কেউ দেখে না উৎস খুঁজতে। তাদের কষ্টের ভাষা এতটাই নিশ্চল যে, পৃথিবী ভাবে এরা নিশ্চুপ পাথর। অথচ এই পাথরের ভেতরেই জমাট বেঁধে থাকে প্রাচীন সমুদ্রের গান।
মনে হয়, তারা প্রতিদিন মুখোশ পরেন—কাজের টেবিলে, বাজারের ভিড়ে, হাসির ছলে। কিন্তু রাত নামলে সেই মুখোশের নিচে জমে থাকা বাষ্প আয়নায় লিখে যায়: "আমি ভাঙিগড়ার যন্ত্রণায় জর্জরিত।" তাদের কাউকে নেই বলার, তাই তারা কথা বলে দেয়ালের সঙ্গে, খাতার পাতায়, আকাশের তারা-ছিদ্রিত চিঠিতে। এই নীরব সংলাপই তাদের রক্তে অক্সিজেন হয়ে ওঠে।
কিন্তু এই একাকিত্বই কেন শক্তি? কারণ, যেখানে কথা হারিয়ে যায়, সেখানে সৃষ্টির জন্ম। নিঃসঙ্গ মানুষটিই যখন আয়নায় নিজের চোখের গভীরে তাকায়, তখন সে আবিষ্কার করে—তার ভেতরেই আছে এক মহাদেশ, যেখানে বেঁচে আছে হাজারো অচেনা আত্মা। প্রতিটি নিঃশ্বাসই হয়ে ওঠে বিদ্রোহ, প্রতিটি নীরবতা—একটি অনন্ত প্রশ্ন।
হ্যাঁ, তারা বেঁচে আছে কারণ তারা শিখে গেছে ব্যথাকে সেলাই করতে নিজের হাতেই। তাদের একাকিত্ব কোনো পরাজয় নয়, এটি এক ধরনের টিকে থাকার কৌশল—যেমন মরুভূমির ক্যাকটাস জলের স্মৃতি ধরে রাখে কাঁটার ভেতর। তাদের নিশ্চুপতা আসলে পৃথিবীর দিকে তাক করা এক প্রশ্ন: "তুমি কি কখনো শুনেছো নীরবতার সিম্ফনি?"
এই একাকী মানুষেরা পৃথিবীর ছায়াছবির লাইব্রেরিয়ান—তাদের ভেতরে জমে থাকা ব্যথাই একদিন হয়ে উঠবে কবিতা, গান, বা নক্ষত্রের পথ। তারা হয়তো কাউকে কিছু বলে না, কিন্তু তাদের নীরবতা চিৎকার করে: "আমি টিকে আছি। আর তাই, আমার বেঁচে থাকা সম্ভব।"