এই ছবিটায় যে তরুণী হেসে আছে, আলো ছুঁয়েছে যার কপোল, নাম তার নাবিলা। আমার সবচেয়ে ছোট বোন। জন্মের ব্যবধান এক যুগের; আমি আর নিশাত তার থেকে এতটাই দূরে, যেন ভিন্ন এক প্রজন্মের সূচনা সে। আব্বু চলে যাবার পর, পৃথিবীর রূক্ষতাকে বুকে নিয়ে বেড়ে ওঠা সেই মেয়েটির ভবিষ্যৎ নিয়ে রাতের পর রাত বুকের ভেতর কাঁটা হয়ে বিঁধত। কীভাবে এত বড় হবে? কীভাবে পাড়ি দেবে জীবনের কঠিন পথগুলো? কীভাবে খুঁজে নেবে তার নিজস্ব ছন্দ? অজানা এক আতঙ্কে ছেয়ে থাকত মনের আকাশ।
কিন্তু আজ? নাবিলার ঠিকানা টরেন্টোর কোলে, পৃথিবীর বুক চিরে চলা তার হাওয়ায়। সে তো নিজেকেই একের পর এক অভিজ্ঞতার খাতায় লিখে চলেছে। টেন্টব্রিজের বিবিএ ডিগ্রি হাতে নেওয়ার পরই হাঁপ ছেড়ে বলেছিল, 'এবার রান্না!' — তিনটি দীর্ঘ বছর হারিয়ে গেল ফোড়ন, ফেনান, আর স্বাদের রহস্যে। আর শেষ দিন? হিলটনের চাকরির খবরটা এসেছিল যেন কোনও স্বপ্নের ডাক। মনে হয়েছিল, হয়তো এবার থিতু হবে পা।
ভুল হয়েছিল। হিলটনের চাকরি ছাড়ল সে, এক বা দেড় বছরের মাথায়। তারপর? একটার পর একটা কাজ এসেছে জীবনে, হাত বাড়িয়েই ছুঁয়ে নিয়েছে, আবার ছেড়েও দিয়েছে অনায়াসে। আমি যেখানে চাকরির নিরাপদ খোপে বসে থরথর কাঁপি, সেখানে তার কাছে এ যেন খেলার মাঠে দৌড়ানো! সে ছুঁড়ে ফেলে দেয় যা তার কাছে আবদ্ধতার নামান্তর।
পৃথিবীটাকে সে চোখে দেখছে, ত্বকে মাখছে, বুকে টেনে নিচ্ছে। কয়েক বছর আগেই এক ঢিলে মেরেছে তিনটি মহাদেশ। কয়েক মাস আগে একাই পাড়ি দিল ইউরোপের প্রান্তর থেকে প্রান্তরে। আর এবার? দেখলাম নিজের নামে গাড়িটা কিনে ফেলেছে! অবাক হয়েছি। কখন যে আমার সেই ছোট্ট বোন, যাকে নিয়ে এত ভয়, এত শঙ্কা, পৃথিবীর এত বড় আয়তনকে নিজের দুই হাতে জয় করে নিল, বুঝতেই পারিনি। সে তো গল্পের সেই নায়িকা, যে অলক্ষ্যে বেড়ে উঠে, নিজের ডানাগুলো মেলে ধরে।
এখন আর সেই আগের মতো চিন্তা নেই। বুকের ভেতরকার কাঁটা গলে গেছে। নাবিলা শিখিয়েছে, জীবনকে আলিঙ্গন করাই তার ধর্ম। সে নিজের পথ নিজেই তৈরি করছে, পাথর সরে গেলে ফুল ফোটায়। ভাবি না আর তার ভবিষ্যৎ নিয়ে। সে তো নিজেই এখন তার ভবিষ্যতের স্রষ্টা। তার উড়ান এখন সম্পূর্ণ নিজস্ব, নির্ভার, নির্বিঘ্ন। নাবিলা আমার সেই ছোট বোন, যে বড় হয়ে গেছে পৃথিবীর বুকে নিজের এক জোড়া পায়ের দাগ এঁকে, আর আমাকে শিখিয়েছে মুক্তির আস্বাদ। এখন সে শুধু আমার নয়, নিজের জীবনটারও পরিপূর্ণ অধিকারী। তার জন্য শুধু ভালোবাসা, আর একটুখানি ঈর্ষা – সেই উড়ানের স্বাধীনতার জন্য, যে স্বাধীনতা সে এত সহজে হাতের মুঠোয় পেয়েছে। আর চিন্তা? সে তো এখন আকাশের পাখির পথের মতোই মুক্ত।