মিশর আমার জন্য শুধু একটি দেশ নয়, এটি এক মহাকাব্যিক প্রতীক্ষা—যেখানে প্রতিটি বালিকণা ফারাওদের পদচিহ্নের গল্প কানে ফিসফিস করে, নীল নদের জল ক্লিওপেট্রার অশ্রুতে লবণাক্ত, আর মরুভূমির বাতাসে ভাসে আলেকজান্ডারের শেষ নিঃশ্বাস। তবুও কেন যেন এই স্বপ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতেই আমি কাঁপি। হয়তো ভয়, এই বিশাল ইতিহাসের সামনে আমি একা এক ফোঁটা জল; হয়তো ভাবি, এই নশ্বর দেহে কি এত বড় এক মহাদেশের গল্প ধারণ করা সম্ভব?
গিজার মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিডগুলো যেন মহাকালের চোখ। তারা দেখেছে রামসেসের বিজয়রথ, টলেমির প্রেমঘটিত ষড়যন্ত্র, নেপোলিয়নের বিস্মিত চোখ। কিন্তু আমি যখন সেখানে দাঁড়াব, তখন কী দেখবে তারা? একজন ক্ষুদ্র মানুষের হৃদয়কম্পন, নাকি তার অস্তিত্বের ক্ষণস্থায়ী ছায়া? হয়তো পাথরের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা সেই সমস্ত রহস্য আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে না, তবুও আমি জানি, স্ফিংক্সের মুখের সেই হালকা হাসি আমাকে বলবে—"তুমি এসেছো কারণ তুমি উত্তর খোঁজার চেয়েও প্রশ্নকে ভালোবাসো।"
নীল নদের ক্রুজে ভেসে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি আমি। কল্পনায় দেখি, জুলিয়াস সিজার যেমন ক্লিওপেট্রাকে রোমের হাত থেকে বাঁচাতে এই নদীতেই নৌকা সাজিয়েছিলেন, তেমনি মার্ক অ্যান্টনির জন্য ক্লিওপেট্রার আত্মহননের পথও এই নীল জল দিয়েই গিয়েছিল। কিন্তু আমার নৌকা কি সেই ইতিহাসের গর্ভে ঢুকতে পারবে? নাকি পর্যটকের ভিড়ে হারিয়ে যাবে প্রাচীন প্রেমের সুর? তবুও স্বীকার করি, এই নদীর তীরে দাঁড়ালেই মনে হবে—প্রতিটি তরঙ্গ যেন বলছে, "প্রেম কখনো মরে না, এটি শুধু মিশে যায় সময়ের স্রোতে।"
আবু সিম্বেলের যে মন্দিরটিকে পুরো উঁচু পাহাড়ে তুলে ফেলা হয়েছিল, সেটি কি মানুষের জয়ের নিদর্শন, নাকি প্রকৃতির প্রতি এক চ্যালেঞ্জ? রামসেস II-এর মূর্তিগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, তিনি এখনো বলছেন, "আমিই মহান!" কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, আবু সিম্বেলের পুনর্জন্ম তো প্রমাণ করে—ইতিহাসকে বাঁচাতে গেলে তাকে স্থানান্তর করতে হয়, তাকে আধুনিকতার সাথে আপস করতেই হয়। এখানে এসে আমি কি খুঁজব—মন্দিরের গৌরব, নাকি নিজের অস্তিত্বের ক্ষুদ্রতা?
বিবলিওথিকা আলেকজান্দ্রিনার ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আমি ভাবি, আলেকজান্ডার কি ভেবেছিলেন তাঁর এই শহর একদিন পথভ্রষ্ট সমুদ্রযাত্রীদের আশ্রয় হবে? সিয়ার ওরাকলের মরুদ্যানে তিনি কি সত্যিই দেবতা রার আশীর্বাদ পেয়েছিলেন, নাকি মরীচিকার পিছনে ছুটেছিলেন? আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় হাঁটলে আজও মনে হয়, প্রতিটি ধুলিকণায় লুকিয়ে আছে হিপেশিয়ার শেষ চিৎকার, বা কাভাফির কবিতার অদৃশ্য অক্ষর।
মেম্ফিসের ধ্বংসাবশেষে পড়ে থাকা রামসেসের ভাঙা মূর্তি যেন স্মরণ করিয়ে দেয়—"সময় সবকিছুই গ্রাস করে।" অথচ নুবিয়ার কালো মানুষদের গ্রামে গেলে বোঝা যায়, সভ্যতা আসলে রক্তে, না পাথরে? এলিফ্যান্টাইন দ্বীপের মন্দিরে খনুমের উপাসনা কি আজও হয়? নাকি সেটিও পর্যটকের ক্যামেরার ফ্ল্যাশে ম্লান হয়ে গেছে?
তবুও হয়তো আমি যাব না, কারণ, মিশর যাওয়া মানে শুধু টিকেট কাটা নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক যাত্রা। এই যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে হয় হৃদয়কে। কখনো অর্থের অভাব, কখনো সময়ের দুষ্টুমি, কখনো ভয়—এসবই তো যেন স্ফিংক্সের ধাঁধা। কিন্তু আমি কি হেরোডোটাসের মতোই ভুলে যাব স্ফিংক্সের কথা? নাকি ওই রহস্যময় প্রাণীর সামনে দাঁড়িয়ে বলব, "আমি এসেছি আমার সমস্ত অসম্পূর্ণতা নিয়ে, তুমি আমাকে গ্রাস করো বা মুক্তি দাও!"
কিন্তু আমি যাবই তো!
হ্যাঁ, মিশর যাবই। যদি আজ না-ও পারি, কাল যাব। যদি কালও না হয়, তবু যাব। কারণ, মিশর আমার ভালোবাসার নামান্তর। এটি আমার অস্তিত্বের সেই অংশ যা কখনো মরুঝড়ে মরিচিকা হয়, কখনো নীল নদের অশ্রু। হয়তো একদিন সত্যিই সাক্কারার পিরামিডের ছায়ায় বসে লিখব—"আমি পৌঁছেছি।" না পৌঁছালেও লিখব—"চেষ্টা করেছি।" কারণ, মিশর শুধু একটি গন্তব্য নয়, এটি এক অন্তহীন যাত্রা—যেখানে প্রতিটি পাথর, প্রতিটি নিশ্বাস ইতিহাসের সাথে আমার ব্যক্তির সংলাপ।
মিশর আমার মক্কা। সেখানে পৌঁছাতেই হয়। নইলে পরজন্মে ফারাও জিজ্ঞাসা করবেন, "তুমি কি আমার পিরামিডের নিচে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁজে পাওনি?" আর আমি লজ্জায় মাথা নত করে বলব, "না, আমি তো ব্যস্ত ছিলাম টিকেটের দাম গুনতে।"
নিশ্চয়ই যাব - আজ না হোক কাল, কিংবা পরশু। কারণ, স্বপ্ন আর বাস্তবতার যুদ্ধে জয়ী হতেই মানুষ বেঁচে থাকে। 
