
পৃথিবীর বুকে একদিন জঙ্গলের গহিনে জেগে উঠেছিল সূর্যকিরণে ঝলমলে পিরামিড, রাজপ্রাসাদের মাথায় উড়েছিল রাজকীয় পতাকা, মাটির নীচে শায়িত ছিল স্বর্ণখচিত সমাধি। মায়ারা লিখে গিয়েছিলেন মহাকালের গণনা, গড়ে তুলেছিলেন পাথরের শহর—যেখানে প্রতিটি চিহ্ন ছিল নক্ষত্রের ভাষা। কিন্তু একদিন সেই মহিমান্বিত নগরীগুলো নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মন্দিরের গায়ে জমে থাকা শিশিরের মতো মায়ারা মুছে গেলেন ইতিহাসের পাতায়। কেন? কী সেই রহস্য, যা আজও প্রত্নতাত্ত্বিকদের হৃদয়ে জ্বালায় অমীমাংসিত প্রশ্ন?
*****************************************************

খ্রিষ্টাব্দ ৭০০ সাল। মধ্য আমেরিকার গহন অরণ্যে মায়া সভ্যতা তখন স্বর্ণযুগে। পালেঙ্ক, টিকাল, কোপানের মতো মহানগরী জ্যোতিষ্কের মতো জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু অচিরেই নেমে এল অন্ধকার। ৮০০ সাল নাগাদ পালেঙ্কের শেষ রাজা ওয়াক কিমি পাকাল মুকুট পরলেন, কিন্তু তাঁর অর্ধসমাপ্ত মন্দির-২২ আজও কথা বলে—শিল্পীরা হঠাৎ যেন রং ফুরিয়ে ফেললেন। শহরের বাসিন্দারা চলে গেলেন অসমাপ্ত কাজ ফেলে, যেন অদৃশ্য কোথাও সময়ের ডাক পড়েছে। টোনিনা, কোপান, টিকাল—একেকটি নগরী পরিণত হতে লাগল নীরব প্রস্তরসৌধে।

মায়া শহরগুলোর বুকে তখন যুদ্ধের দাবানল। ডোস পিলাসের যোদ্ধারা প্রতিবেশী শহর দখলে মাতোয়ারা। আগুয়াটেকার দুর্গপ্রাচীর গড়ে উঠল ভাঙা মন্দিরের পাথরে। কিন্তু বিজয়ীরাও কি জানে পরাজয়ের স্বাদ? টিকাল বিজয়ী হয়েও খ্রিষ্টাব্দ ৮৪৯ সালে পরিত্যক্ত হলো। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে মিলিয়ে গেল অভিজাত রক্ত, কিন্তু এরাই তো আগে লড়াই জিতেছিল! কানকুয়েনের প্রাসাদে পাওয়া গেল নৃশংসতার চিহ্ন—ধনী পরিবারগুলোর লাশ ফেলা হয়েছিল জলাধারে। যুদ্ধ কি তবে পতনের একমাত্র কারণ? না, কারণ খুঁজতে হবে প্রকৃতির গর্ভে।

মায়ারা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন মাটির ভাষা। কোপানের উপত্যকায় গাছ কেটে ফেলায় মাটি হয়ে উঠল অনুর্বর। স্টাকো তৈরির জন্য জ্বলল অরণ্য, আর বৃষ্টি হারাল তার পথ। খ্রিষ্টাব্দ ৮০০ সালের দিকে এল চিচন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে আকাশ কালো করে ছাই ছড়াল পালেঙ্কে। দুই বছর ধরে বৃষ্টিহীনতা কেড়ে নিল ফসল। অথচ আশ্চর্য! পিটেক্সবাটুনে কোনো খরা নেই, বরং সেখানে মৃতদেহের দাঁতে নেই দুর্ভিক্ষের চিহ্ন। প্রকৃতি কি তবে নৈর্বক্তিক? নাকি মানবসৃষ্ট এই বিপর্যয়?

মায়াদের ক্যালেন্ডার ছিল মহাজাগতিক ছন্দে বাঁধা। ১০ম বাক’টুন—৪০০ বছরের এক চক্র—খ্রিষ্টাব্দ ৮৩৫ সালে এল যেন নতুন যুগের সূচনা। রাজারা একাকী শাসনের বদলে "পরামর্শ সভায়" বসতে লাগলেন। কোপানের প্যানেলে রাজা পোপোল নাহ-কে দেখা যায় অভিজাতদের মাঝে। যেন ক্ষমতা ভাগ হয়ে গেছে। এই সময়েই মায়ারা শহর ছাড়লেন—নতুন চক্রের সূচনায় পুরনোকে সমাধিস্থ করতে। সমাধির উপর নতুন ঘর? না, এবার গোটা শহরই হয়ে উঠল পূর্বপুরুষের মন্দির। ইউকাটানের চিচেন ইটজায় ৪০০ বছর পর আবারও একই ঘটনা—১১তম বাক’টুনে নীরবতা।

এই পতন শুধু মায়াদের নয়। তেওটিহুয়াকানের পিরামিড পুড়ে ছাই, চোলুলার বিশাল মন্দির গড়ে উঠল ধ্বংসের পর। ওহাকা উপত্যকায় মন্টে আলবানের জাপোটেক সংস্কৃতি মিক্সটেকের কাছে হার মানল। পশ্চিম মেক্সিকো থেকে আনাসাজি সংস্কৃতি—সবাই যেন একই সুরে গাইল বিদায়ের গান। বাণিজ্য পথে ছড়াল বিপর্যয়, রাজনীতি ও প্রকৃতি মিলে তৈরি করল মহাযুগের সমাপ্তি।

মায়াদের শহর আজও জঙ্গলে দাঁড়িয়ে—পাথরের গায়ে উৎকীর্ণ তারা কী বলতে চায়? যুদ্ধ, খরা, বন উজাড়, আগ্নেয়গিরি... সবই সত্য। কিন্তু ১০ম বাক’টুনের ডাকে মায়ারা কি স্বেচ্ছায় বিদায় নিয়েছিলেন? নাকি মহাকালের গণনায় লুকিয়ে আছে উত্তর? ভিনগ্রহ তত্ত্ব হয়তো কল্পনাপ্রবণদের মধুর স্বপ্ন, কিন্তু প্রকৃত রহস্য তো এখনও অরণ্যের পাতার ফাঁকে ফাঁকে হেসে যায়। প্রতিটি পরিত্যক্ত স্তম্ভ, প্রতিটি অর্ধসমাপ্ত মন্দির—একটি সভ্যতার শেষ উঁকি, যা বলে যায়: "আমরা চলে গেলাম, কিন্তু আমাদের গল্প এখনও তোমাদের মধ্যেই বেঁচে আছে।"